করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অর্থনীতি থমকে যাওয়ার শঙ্কা

চলতি বছরের মার্চ থেকে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অচলাবস্থা তৈরি করেছিল করোনা মহামারী। তবে জুন থেকে ধীরে ধীরে সচল হতে থাকে উৎপাদনের চাকা, ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে অর্থনীতি। কিন্তু এরই মধ্যে ফের আঘাত হেনেছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এতে আবারো অর্থনীতির থমকে যাওয়ার শঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট মহল।
এজন্য নীতিনির্ধারণে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এমনকি দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় নতুন করে প্রণোদনা ঘোষণার বিষয়টিও উঠে এসেছে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে করোনা মোকাবেলায় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণে প্রস্তুত রয়েছেন তারা।
করোনা মোকাবেলা ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার নিয়ে গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ। ‘কভিড-১৯ মোকাবেলা এবং টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া প্রণোদনা প্যাকেজ’ শীর্ষক এ সিরিজ মতবিনিময় সভার প্রথম দিনের সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস।
এতে ‘কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা এবং অর্থনীতির সামগ্রিক চাহিদা ও সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার। সংলাপে বক্তারা বলেন, এখন কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে হবে। এজন্য প্যাকেজ বাস্তবায়নে আরো নজর দিতে হবে। আর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নে একটি স্বাধীন মূল্যায়ন করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের মতো দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতির জন্য এ পদক্ষেপ খুবই প্রয়োজন ছিল। সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। রফতানি খাতকে টিকিয়ে রাখতে করোনার প্রথম ধাক্কা চলাকালে সরকার ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে এ খাতের উদ্যোক্তারা উদ্বিগ্ন। তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার সতর্ক রয়েছে এবং নানা ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশ বর্তমানে করোনার প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে। এ অবস্থায় করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামাল দিয়ে কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখা নিয়ে ভাবতে হবে।
তিনি বলেন, এসএমই খাতের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও সে প্রণোদনা অর্ধেকের কাছেও পৌঁছেনি। এদিকে নজর দেয়া দরকার। ব্যাংকগুলো বড় গ্রাহকের স্বার্থ দেখছে। কিন্তু ছোটদের দিকে খেয়াল দিচ্ছে না। কারণ এখানে ব্যাংকের মুনাফা কম। মনে রাখতে হবে শুধু মুনাফা নয়, দেশের দিকেও তাকাতে হবে।
কভিড পরিস্থিতিতে সরকার দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হয়েছে জানিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনে টিসিবির মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি করা হয়েছে। ফলে কঠিন পরিস্থিতিতেও দেশে কোনো পণ্যের সংকট হয়নি বা মূল্য বৃদ্ধি ঘটেনি।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার সময়ই কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সমস্যার বিষয়টি আমাদের ভাবনার মধ্যে ছিল। এসব ঋণে সার্ভিস চার্জ বেশি ও ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তার কারণে ব্যাংকগুলো এতে তেমন আগ্রহ দেখায় না। ক্ষুদ্র শিল্প ও নারী উদ্যোক্তাদের প্রণোদনার আওতায় আনতে প্রয়োজনে পৃথক প্যাকেজ ঘোষণা করা হবে।
মূল প্রবন্ধে অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, দেশে কভিডের প্রভাব পড়ার শুরুতেই সরকার বিভিন্ন নীতিগত পদক্ষেপ নিয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতি এখন পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, এ পর্যন্ত প্রণোদনা প্যাকেজের ৫৫ শতাংশ অর্থ ছাড় করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৫ শতাংশ অর্থ এখনো ছাড় করা হয়নি।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও ভুটানে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিস মার্সি মিয়াং টেমবোন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে দুটি দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। প্রথম শ্রমিকদের সহায়তা করা, বিশেষ করে পোশাক খাতের শ্রমিকসহ দৈনিক মজুরিভিত্তিক শ্রমিকদের সব ধরনের সহায়তার আওতায় আনতে হবে। এতে তাদের কর্মসংস্থান টিকে থাকবে। দ্বিতীয় হচ্ছে এসএমই খাতের উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে হবে।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, আরো একটি ধাক্কা নিয়ে করোনার দ্বিতীয় ওয়েব এগিয়ে আসছে। এ নিয়ে শঙ্কিত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি ৮ শতাংশ, জার্মানিতে ১০ শতাংশ, জাপানে ২৮ শতাংশ, ইতালিতে ৩০ শতাংশ, কানাডায় ৩০ শতাংশ ও স্পেনে ৬ শতাংশ কমেছে। এর আগে পোশাকের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক অর্ডার বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আগামী পাঁচ বছরের জন্য স্বল্প সুদে প্যাকেজের আওতায় ঋণ দরকার।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনিন আহমেদ বলেন, কভিড পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক খাত ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ছোট ও মাঝারি শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব কারখানায় কর্মরত বয়স্ক ও স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আনা দরকার।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৯ শতাংশ কারখানা এখনো বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় রয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ। প্রণোদনা ঋণ বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোর দীর্ঘসূত্রতা একটি বড় সমস্যা বলে উল্লেখ করেন তিনি।